ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক, বর্ধমানঃ বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দিরে পুরোহিতদের পুজো করার ঘটনায় দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ এবার চরমে উঠল। গত ২৯ আগষ্ট সর্বমঙ্গলা মন্দিরের প্রাক্তন পুরোহিত ক্ষেত্রনাথ অধিকারী দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যান। ক্ষেত্রনাথবাবুর ৩ পুত্র উত্তরাধিকার সূত্রে এই সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পুরোহিত। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ক্ষেত্রনাথবাবুর দুই ছেলের পুজোর পালা পড়ায় তাঁরা সর্বমঙ্গলা মন্দিরে নিত্যপুজো করতে যান। অভিযোগ, এই সময় বহিরাগত বেশ কয়েকজন তাঁদের অশৌচ অবস্থায় একবছর মন্দিরে প্রবেশ করা যাবেনা এবং পুজো করা যাবে না বলে আটকান। আর তা নিয়ে বাক বিতণ্ডায় জড়ায় দুটি পক্ষ।
ক্ষেত্রনাথবাবুর ছেলে তাপস অধিকারী(গোপন) জানিয়েছেন, এই সময় বহিরাগত শ্যামাপ্রসাদ ব্যানার্জ্জীর নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন তাঁর দুই দাদাকে বেধড়ক মারধোর করতে থাকেন। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে হাজির হলেন তাঁকে মাটিতে ফেলে রড, লাঠি দিয়ে মারা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনায় ৪জনের নামে বর্ধমান থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে গেলে নানান অজুহাতে পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এরপর তাঁরা গোটা বিষয়টি জেলা পুলিশ সুপারকে জানান। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তদের কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এদিকে, রবিবার অভিষেক বিয়েবাড়িতে হিউম্যান রাইটস সিপিডিআর ইণ্ডিয়ার একটি সভায় এই ঘটনায় রীতিমত উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে নামারও হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই সভায় হাজির ছিলেন মন্দিরের অনেক পুরোহিতও। অন্যদিকে, এদিন সর্বমঙ্গলা মন্দিরের বেশ কিছু পুরোহিত রীতিমত ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন,মন্দিরের গুটিকয়েক পুরোহিতের সঙ্গে অশুভ আঁতাতের জেরেই বহিরাগতরা বারবার মন্দিরে ঢুকে মন্দিরের পরিবেশকে কলঙ্কিত করছেন। এমনকি ওই পুরোহিত শ্রেণীরা অদৃশ্য ক্ষমতাবলে দীর্ঘদিন ধরে পদ আঁকড়েও রয়েছেন বলে তাঁরা অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি পুরোহিত কমিটির সভায় ৪৫জন পুরোহিতের মধ্যে ৪৩জন পুরোহিত দুই পুরোহিতকে ট্রাষ্ট কমিটি থেকে সরিয়ে দেবার ঐক্যমত্য সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের কপি জেলা প্রশাসনের সর্বত্র দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবী জানান তাঁরা। কিন্তু তারপরেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় রীতিমত উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এদিন পুরোহিতদের পক্ষ থেকে।
শুধু তাই নয়, বেশ কিছুদিন ধরেই তাপস অধিকারী সহ তাপস অধিকারীর স্ত্রী ও পুত্রকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে এদিন। এব্যাপারেও জেলা প্রশাসনের কাছে তাঁরা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এমতবস্থায় সর্বমঙ্গলা মন্দিরকে ঘিরে রীতিমত বিতর্ক শুরু হয়েছে শহর জুড়ে। অভিযোগ উঠেছে, তাপস অধিকারী এবং ভাইদের ঠেকাতে সম্প্রতি মন্দিরের ট্রাষ্ট কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে পুরোহিতদের কোনো নিকট আত্মীয় মারা গেলে সংশ্লিষ্ট পুরোহিত একবছর মন্দিরে উঠতে পারবেন না। যদিও তা নিয়ে নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কারণ এর আগেও মন্দিরের একাধিক পুরোহিতের নিকট আত্মীয় বিয়োগ হলেও তাঁরা অশৌচ অবস্থাতেই মন্দিরের কাজকর্ম পরিচালনা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তাপসবাবু এদিন অভিযোগ করেছেন, সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সম্পত্তি লুঠেপুটে খাবার জন্য একশ্রেণী সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি তাতে বারবার বাধা দেওয়াতেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এব্যাপারে তিনি প্রশাসনের নিরপেক্ষ তদন্তেরও দাবী জানিয়েছেন। অপরদিকে, রবিবার যখন সিপিডিআরের সভা চলছে সেই সময় তাপসবাবুর বাড়ির সামনেই সর্বমঙ্গলা পাড়া নাগরিকবৃন্দের নামে তাপস অধিকারীর বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলে ব্যানার দেওয়ায় বিতর্কের পারদ আরও চড়েছে। অনেকেই মনে করছেন এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ রীতিমত পায়ে পা দিয়ে গোটা এলাকায় অশান্তি পাকানোর চেষ্টা করছেন।
যদিও এই ঘটনা সম্পর্কে এদিন মন্দিরের ট্রাষ্ট কমিটির সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষ জানিয়েছেন, ভক্তরা আপত্তি তোলে অশৌচ অবস্থায় একবছর মন্দিরে উঠতে পারবে না বলে। তারপরেই দুজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতকে ডেকে এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, তিনি সম্প্রতি সম্পাদক পদে এসেছেন, তাই আগে কি হয়েছে তা তাঁর জানা নেই। পুরোহিতদের রেজ্যুলেশন সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, পুরোহিতদের দাবীদাওয়ার বিষয়টি তিনি পেয়েছেন, এব্যাপারে কমিটির সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, মন্দিরে বহিরাগতদের দৌরাত্মের বিষয় নিয়ে তিনি কোনো অভিযোগ পাননি।
অন্যদিকে, শ্যামাপ্রসাদ ব্যানার্জী জানিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ঘটনার দিন তাঁরা মন্দিরের বাইরে ছিলেন। ভেতরে কয়েকজন ভক্ত গোপনবাবুদের মন্দিরে ঢোকার বিষয় নিয়ে আপত্তি তোলেন। তাঁরা বিষয়টি সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষকে জানান। সঞ্জয় ঘোষ এরপর তাঁদের মন্দিরে ডাকেন। এরপর তাঁরা মন্দিরে গেলে ভক্তদের দাবীকে যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় তাঁরা ভক্তদের পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু কাউকেই তাঁরা মারধোর করেননি। উল্টে তাপসবাবুই স্বপন হাজরাকে হেনস্থা করেন। তিনি জানিয়েছেন, এদিন মানবাধিকার একটি সংগঠন তাপসবাবুর হয়ে সভা করায় আসল সত্য জানাতে তাই তাঁরাও পাল্টা মন্দিরের সামনে মাইক বাজিয়ে সভা করে জনসাধারণকে সত্যটা জানাতে চেয়েছেন। পাল্টা তিনি অভিযোগ, তাপসবাবু মন্দিরের একটি অংশ বেআইনিভাবে দখল করে আছেন। এমনকি মন্দিরের সামনে তাঁর বিয়েবাড়িটিও অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও তার বিরুদ্ধে তাপসবাবু জানিয়েছেন, দুটিক্ষেত্রেই তিনি যে বৈধ পথেই রয়েছেন তা এর আগেও প্রশাসনের কাছে দাখিল করেছেন। আদালতের রায়ও তাঁর পক্ষে রয়েছে। এদিকে, দুপক্ষের এই ঘটনাকে ঘিরে কার্যত গোটা বর্ধমান শহর জুড়েই তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। মন্দিরের পুজোর পরিবেশের বদলে এখন রীতিমত চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন দুপক্ষের এই লড়াই।