ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,গলসি: বর্ধমানের গলসী থানার শিকারপুর গ্রামে ওভারলোর্ডিং বালি বোঝাই ডাম্পার উল্টে গিয়ে একই পরিবারের ৫জনের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রামবাসীদের জমে থাকা ক্ষোভ শুধু শিকারপুরই নয়, আশপাশের আরও ৩কিমি এলাকা জুড়ে ছড়িয়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে শিকারপুর গ্রামে দামোদরের বাঁধের ধারে ওভারলোর্ডিং বালি বোঝাই ডাম্পার উল্টে মৃত্যু হয় একই পরিবারের ৫জনের। এরপরই এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শিকারপুর বালিঘাটের মালিক সুব্রত সাহার বালিঘাটে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ৪টি জেসিপি মেশিন, দুটি ডাম্পার, দুটি ট্রাক্টর সহ বেশ কয়েকটি মোটরবাইক এবং দামোদরের মাঝ থেকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বালি তোলার জন্য ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি ছাকনি মেশিনেও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
কার্যত, শিকারপুর গ্রামের এই ঘটনায় যখন সকলেরই চোখ নিবদ্ধ ছিল শিকারপুর গ্রাম ঘিরেই, সেই সময় এই গ্রামবাসীদের ক্ষোভের আগুন ছড়িয়েছে পাশের শিবতলা এবং ভাগাবাঁধ এলাকাতেও। শিকারপুরের পাশাপাশি শিবতলা এবং ভাগাবাঁধ এলাকার দুটি বালিঘাটেও অভিযান চালায় গ্রামবাসীরা। সেখানেও বালিঘাটের অস্থায়ী অফিস সহ জেসিপি মেশিন সহ যন্ত্রপাতিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনের নির্দেশে বর্তমানে এই এলাকার প্রায় ৮টি ঘাটকে বন্ধ রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার সেই ঘটনার পর কেটে গেছে দুটি রাত। কিন্তু শুক্রবার এই গোটা এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষোভের আগুন এখনও জ্বলছে। শিকারপুর বালিঘাটের পুড়িয়ে দেওয়া গাড়িগুলি থেকে এখনও গরম বাষ্প বেড়িয়ে আসছে। গোটা এলাকা জুড়ে গ্রামবাসীরা একেবারেই চুপচাপ। তবে তাঁদের শ্যেন নজরদারী রয়েছে প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বালিখাদের ওপরই। কারা আসছেন, কারা যাচ্ছেন সবটাই তাঁরা লক্ষ্য রাখছেন। কিন্তু সেদিনের ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করলেই তাকে সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারই মাঝে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাতে যা ঘটেছে তারজন্য শিকারপুর গ্রামের মানুষের ক্ষোভ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বুধবার সারাদিন যেভাবে মৃতদেহ আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে, রাজনীতি করা হয়েছে তার নেপথ্যে রয়েছে বহিরাগত কিছু মদ্যপ মানুষ। তাঁরাই পরিকল্পিতভাবে গোটা বিষয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তাই শিকারপুর গ্রামে এবং শিকারপুর বালিঘাটকে কেন্দ্র করে ঘটনা ঘটলেও এই ঘটনার রেশ ছড়িয়েছে শিবতলা এবং ভাগাবাঁধ এলাকাতেও। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, ভাগাবাঁধ বালিঘাটে উত্তেজিত গ্রামবাসীরা প্রায় ৭টি জেসিপি মেশিনকে পুড়িয়ে দিয়েছে। শিবতলা বালিঘাটেও ২টি জেসিপি মেশিনে আগুন লাগানো হয়েছে। ঘটনার ২দিন পরেও এখনও এই সমস্ত পোড়া মেশিনগুলি থেকে আগুনের তাপ বেড়িয়ে আসছে।
যদিও এব্যাপারে কেউই মুখ খুলতে চাননি। জানা গেছে, শিকারপুর ঘাটে মঙ্গলবার সন্ধ্যেয় প্রায় ১৬ লিটার কেরোসিন তেল আনা হয়েছিল ছাকনি মেশিনের জন্য। তা মজুদ ছিল। মঙ্গলবার রাতে দুর্ঘটনার পর গ্রামবাসীদের একাংশ ওই কেরোসিন তেল দিয়েই একের পর এক গাড়ি ও মেশিনে আগুন লাগায়। এখনও পর্যন্ত জানা গেছে, সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করা হয়েছে। একইসঙ্গে শিকারপুর অঞ্চলের ৩টি বালিঘাটে যেভাবে আগুন লাগানো এবং লুঠপাটের ঘটনা ঘটেছে তার জন্য রীতিমত বেকায়দায় পড়েছেন বালিঘাট মালিকরা।
অন্যদিকে, জানা গেছে, বিশেষ করে শিকারপুরের বালিঘাটকে কেন্দ্র করেই বালিঘাট এলাকায় তথা দামোদরের বুকে বালির চড়ে ছিল বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল, দোকান। দুর্ঘটনার পর সেই সমস্ত দোকানপাটগুলিতেও ব্যাপক লুঠপাট চালানো হয়েছে। কেবলমাত্র এই বালিঘাটেই প্রায় ২৫০ শ্রমিক কাজ করতেন, তাঁরা এখন কাজ হারিয়ে রীতিমত চিন্তায় রয়েছেন।
অন্যদিকে, আরও একটি বিষয়ে গ্রামবাসীরা এদিন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যুর পর শাসকদলের নেতারা মৃতদের পরিবারের হাতে এক লক্ষ টাকা করে ও আহত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান তুলে দেন। কিন্তু এরপরেই প্রশ্ন উঠেছে, এই টাকা নাকি বালিঘাট মালিকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, তাহলে শাসকদলের নেতারা কেন এর কৃতিত্ব নিয়েছে।
গ্রামবাসীদের আরও অভিযোগ, আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নাকি আরও বেশি ছিল, কিন্তু কেন ওই পরিমান টাকাই মৃতদের পরিবার গুলোকে দেওয়া হলো সেই বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে গ্রামবাসীদের একাংশ। আর এরপরেই খোদ শাসকদলের দুটি গোষ্ঠীর অন্দরেই তৈরি হয়েছে চাপা উত্তেজনা।