ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: ফের এক ভয়াবহ, মর্মান্তিক ঘটনার পর চোখে আঙুল দিয়ে প্রশাসনকে দেখিয়ে দিল পূর্ব বর্ধমান জেলার গলসি ১ ও ২ ব্লকে কিভাবে বেপরোয়া বৈধ ও অবৈধ বালির ঘাট এবং সেখান থেকে অবৈধভাবে বালি পাচার চলছেই। যার জেরে নিরপরাধ দুই শিশু সহ একই পরিবারের ৫জনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটল।
অথচ গলসী ১ ও ২ ব্লকের দামোদরকে ঘিরে চলতি সময়ে রীতিমত একচেটিয়া বালি কারবারকে ঘিরে দফায় দফায় সংঘর্ষ, বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তারপরেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন এই সমস্ত অবৈধ বালিঘাটগুলি বন্ধে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। কেবলমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া। যার পরিণতিতে মঙ্গলবার গভীর রাতে যখন গোটা দেশ হৈ হুল্লোড়ে আনন্দ করেছেন তখন গলসী থানার শিকারপুর গ্রাম শোকে মূর্চ্ছা গেছেন।
ওভারলোর্ডিং বালি বোঝাই ডাম্পার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢুকে পড়েছিল রাস্তার ধারে একটি বাড়িতে, যেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন বাপি মণ্ডলের পরিবারের ৬জন সদস্য। একজন গুরুতর জখম হয়েছেন, বাকি দুই শিশু সহ ৫জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এদিকে, এই ঘটনার পর গোটা এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। শুরুও হয়েছে রাজনৈতিক তরজাও। চলছে দোষারোপের পালাও। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও চলছে অবৈধ বালির ঘাট।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি গলসী ১ পঞ্চায়েত সমিতি অফিসে ধান কেনা নিয়ে বৈঠক সেরে বর্ধমান ফেরার পথে খোদ পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক বিজয় ভারতী ২নং জাতীয় সড়কে পারাজ মোড়ে ১৭টি ওভারলোর্ডিং বালির গাড়িকে আটক করেন। ওই সমস্ত গাড়ি থেকে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা জরিমানাও আদায় হয়। জেলাশাসক ঘোষণাও করেন, অবৈধ বালি পাচারের ঘটনা রুখতে তৈরী করা হয়েছে বিশেষ টাস্ক ফোর্স, ড্রোণ দিয়ে নজরদারীর পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের পৃথক টিমও নজরদারী চালাবে।
কিন্তু জেলাশাসকের সেই নির্দেশের পরও কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে গলসী ১ অঞ্চলের শিল্যাঘাট এলাকা দিয়ে প্রতিদিনই রাতের অন্ধকারে শয়ে শয়ে ওভারলোর্ডিং বালির গাড়ি যাতায়াত করছেই। নিরব গলসীর ভূমি দপ্তর থেকে গলসী থানার পুলিশও। গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ, শাসক দলের একাংশ এবং প্রশাসনের সঙ্গে অবৈধ আঁতাতের জেরেই এত কিছুর পরেও চলছে এই কারবার। অথচ খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বর্ধমানে প্রশাসনিক সভায় এসে এই অবৈধ বালি পাচার নিয়ে কড়া ভাষায় নির্দেশও দিয়ে যান। অবিলম্বে এই কারবার বন্ধ করার জন্য খোদ গলসী থানার পুলিশ কর্তাদেরও রীতিমত সমঝে দিয়ে যান। কিন্তু নির্দেশ আছে নির্দেশেই।
গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, একটা সময় সিপিএমের নেতারা বর্ধমান জেলার বালিঘাটের কারবার চালাতেন। তখন আজকের শাসকশ্রেণীর নেতারাই তাঁদের কঠোর সমালোচনা করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সবটাই উল্টে গেছে। এখন গলসী ১ ও ২, খণ্ডঘোষ তথা দক্ষিণ দামোদরের প্রায় সমস্ত বালি ঘাটের দখলই নিয়েছে তৃণমূলের নেতারা। দেদার চালিয়ে যাচ্ছেন বালির কারবার।
গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, ব্যবসা করা অন্যায় নয়। কিন্তু বৈধ ব্যবসার পাশেই চলছে অবৈধ কারবার। আর এই অবৈধ বালির কারবারের জেরে গোটা গলসী অঞ্চল জুড়ে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। একদিকে, ওভারলোর্ডিং গাড়ির জন্য রাস্তা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, পরোক্ষে রাস্তা সারাইয়ের জন্য চাপ পড়ছে প্রশাসনের ওপর। দ্বিতীয়ত, অবৈধ বালির গাড়ির জন্য দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। তৃতীয়ত, এই অবৈধ বালির গাড়িকে কেন্দ্র করে চলছে বোমাবাজি, সংঘর্ষ। অথচ এজন্য সরকারী কোষাগারে কোনো অর্থই জমা পড়ছে না।
খাতায় কলমে নিয়ম থাকলেও রাস্তায় সেইসব নিয়মের তোয়াক্কা কেউ করে না। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, গলসী অঞ্চলের একেবারে ছোট নেতা থেকেও বড় নেতা পর্যন্ত মাসোহারার বন্দোবস্ত করা আছে। অভিযোগ উঠেছে, এই মাসোহারা চলছে প্রশাসনিক পর্যায়েও। গলসীর শিল্যাঘাটের এক বালিঘাট মালিক দীনবন্ধু বৈরাগ্য সরাসরি এদিন অভিযোগ করেছেন, বাঁকুড়া জেলার পারমিটে গলসীর বিক্রমপুর ও সিমাসিমি মৌজা থেকে বালি তুলে তা গলসী দিয়েই পাচার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারী নিয়মকে কার্যত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেই নদীর বুক থেকে মেশিন লাগিয়ে দেদার তোলা হচ্ছে বালি। তৈরী করা হয়েছে অস্থায়ী সেতুও।
ফলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে। কিন্তু এসবের থেকেও প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা উড়ছে এই বালিঘাটকে ঘিরেই। তার জেরেই চলছে এই কারবার। দীনবন্ধুবাবু জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে যে আদালতের নির্দেশও মানছে জেলা প্রশাসন। ফলে কেবলমাত্র শিকারপুরের ঘটনা নয়, আগামী দিনে আরও ভয়াবহ কোনো ঘটনা ঘটবে কিনা সেই সন্দেহই তাঁদের মনে দানা বাঁধছে।
এদিকে, মঙ্গলবার বর্ষবরণের রাতে শিকারপুরের এই দুর্ঘটনায় যে বালিঘাট থেকে ওই ওভারলোর্ডিং বালির গাড়ি আসছিল সেই বালিঘাটের মালিক একজন তৃণমূলের সমর্থক বলে জানা গেছে। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবী, ওই ঘাট মালিকের বিরুদ্ধে জোড়ালো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ কিভাবে তার ঘাট থেকে ওভারলোর্ডিং হচ্ছে এই কৈফিয়ত তাঁকেও দিতে হবে।