শান্তনু দাস,পুরুলিয়াঃ কুমোরপাড়া থেকে নয় এখানে ষষ্ঠীতে উমার আগমন হয় ব্যাংকের লকার থেকে,তাও আবার রীতিমতো পুলিশি প্রহরায় ৷ ২৪ ঘণ্টা কড়া পুলিশি নজরদারির মধ্য দিয়েই চলে বোধন,সন্ধিপুজো। দশমীতে আবার একইভাবে উমাকে ফিরিয়েও দিয়ে আসা হয় ব্যাংকে ৷
হ্যাঁ শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। ১৯৬৯ সাল থেকে এটাই রীতি পুরুলিয়ার জয়পুরের রাজবাড়িতে। যার একমাত্র কারন,রাজবাড়ির উমা একশো আট আকবরি স্বর্ণমুদ্রায় তৈরি। শুধু তাই নয়, উমার পুরো শরীর জুড়েই মণি,মুক্তো,হিরে,জহরতের ঝলক।
জয়পুরের এই রাজবাড়িতে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত সোনার উমাকে দেখতেই মূলত প্রতিবছর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড এবং বিহার থেকেও বহু দর্শনার্থী পুজো দেখতে ভিড় জমান বাজবাড়িতে।
রাজ পরিবারের অন্যতম সদস্য শঙ্কর নারায়ণ সিংহ দেও ও প্রশান্ত নারায়ণ সিংহ দেও জানান, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জয়সিংহ পুরুলিয়ার এই প্রান্তে পা রাখেন। তাঁর নামে এই স্থানের নাম হয় জয়পুর।জয়সিংহ উজ্জয়িনী থেকে এসে এই এলাকার মুন্ডা সর্দার খামার মুন্ডাকে হত্যা করে জয়পুরের পত্তন করেছিলেন। প্রাচীনকালে খামার মুন্ডা একটি খাঁড়াকে তাদের ইষ্টদেবী হিসেবে পুজো করতেন। রাজা জয় সিংহ সেই খাঁড়াটিকে মুন্ডা বসতি থেকে ছিনিয়ে নেন। তারপর শক্তির দেবী হিসেবে কোনও মূর্তি ছাড়াই এই খাঁড়াটিকে কলাবউ হিসেবে পুজো করার রীতি প্রচলন করেন।
এর বহুবছর পর সপ্তম রাজা কাশীনাথ সিংহর আমলে দুর্গাপুজোর দিন একটি অঘটন ঘটে যায়। আগুন লেগে কলাবউ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই সময় রাজা কাশীনাথ সিংহ মানত করেন, সোনার প্রতিমা তৈরি করে তাতে রুপোর চালচিত্র লাগিয়ে তবেই মায়ের পুজো করবেন। যদিও এই সংক্রান্ত কোনও নথি নেই, তবে লোকশ্রুতি থেকে এই তথ্য জানা যায়।
শোনা যায়, সোনার বিগ্রহ তৈরির জন্য বারাণসীর স্বর্ণ শিল্পীদের ডেকে পাঠিয়ে ১ কেজি ওজনের সোনার দ্বিভূজা দূর্গা মূর্তি ও ৬০ কেজি ওজনের রুপোর চালচিত্র তৈরি করান। সেই থেকে মহা ধুমধামের সঙ্গে সোনার বিগ্রহই পুজো হয়ে আসছে জয়পুর রাজবাড়িতে। কিন্তু ১৯৭০ সালে ঘটে যায় আরও এক দুর্ঘটনা। একদল ডাকাত হানা দেয় রাজবাড়িতে। বহু খোঁজাখুঁজির পরও তারা সোনার মূর্তিটি না পেয়ে মন্দিরে থাকা সমস্ত অলঙ্কার চুরি করে পালিয়ে যায়।
ঘটনার পরই টনক নড়ে রাজপরিবার ও পুলিশের। তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপারের উদ্যোগে রাজবাড়িতে স্বর্ণ বিগ্রহের নিরাপত্তা দিতে নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। ঠিক হয়, পুজোর পাঁচদিন ছাড়াও বিগ্রহটিকে ব্যাঙ্কের লকারে রাখা হবে। পুজোর সময় লকার থেকে মন্দিরে আনা হবে বিগ্রহ। সেই থেকে প্রতিবছর কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় বিগ্রহটিকে আনা হয় রাজবাড়িতে। পুজো শেষে দশমীর দিন একইভাবে বিগ্রহকে রেখে আসা হয় ব্যাঙ্ক লকারে। ষষ্ঠী,সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই চারদিন মহা ধুমধামের সঙ্গে পুজো হয় জয়পুর রাজবাড়িতে। আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড এবং বিহার থেকেও বহু দর্শনার্থী পুজো দেখতে ভিড় জমান এখানে।