Headlines
Loading...
ভারতে মূর্তি ভাঙার রাজনীতি এবং অনেক প্রশ্ন

ভারতে মূর্তি ভাঙার রাজনীতি এবং অনেক প্রশ্ন


ফোকাস বেঙ্গল নিউজ ডেস্কঃবামেদের সরিয়ে রাজ্যের সিংহাসনে বিজেপির আসীন হবার আগেই রুশ বিপ্লবের নায়ক ভলাদিমির লেনিনের মূর্তি ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেল ত্রিপুরায়। পিছিয়ে রইলনা তামিলনাড়ু। সেখানেও ভেঙে ফেলা হল অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করা দ্রাবিড়ীয় নেতা তথা সমাজসেবী ই ভি রামস্বামীর মূর্তি, লোকে যাকে পেরিয়ার নামেই জানে। মূর্তি ভাঙার সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ল দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। রেনেসাঁর জন্মদাত্রী বাংলার মত রাজ্যেও কালি মাখানো হল ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মত বরেণ্য মানুষের মূর্তিতে। উত্তরপ্রদেশের মীরাটে এরপর আক্রান্ত হলেন স্বয়ং ভারতীয় সংবিধান প্রণেতা। ভাঙা হল ড: বি আর আম্বেদকরের মূর্তি। বাদ গেলেন না জাতীয় বীর নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রং মাখানো হল তাঁর মূর্তিতে। এরপর বঙ্গবাসীকে আশ্চর্য করে দিয়ে বাংলার বুকে মূর্তি ভাঙার তালিকায় চলে এলেন মাইকেল মধুসূদনের মত বিশ্বখ্যাত একজন কবিও। আসানসোলে রং মাখানো হল 'মেঘনাদ বধ' রচয়িতার মুখে।

এসব ঘটনাবলী দেখা ও শোনার পর যে সব প্রশ্ন সামনে আসে,তা হল কারা করছে এসব ? তারা কি আদৌ রাজনীতির লোক ? যারা এসব করছে তারা কি আদৌ জানে কেন তারা এই কাজ করছে? তারা কি জানে এটা উচিত কি অনুচিত ? তারা কি আদৌ জানে কাদের মূর্তি কেন ভাঙছে তারা? তারা কি জানে যাদের মূর্তি ভেঙে কালি মাখানো হচ্ছে তারা কে , কি তাদের পরিচয় ? সব থেকে বড় প্রশ্ন যারা মূর্তি ভাঙছে তারা কি ঐসব মানুষদের পরিচয় বোঝার যোগ্য ?

আসলে ভারতের বুকে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলিতে দুষ্কৃতিদের যে একটা বড় জায়গা রয়েছে একথা এখন আর গোপন নয়। প্রায় প্রত্যেক রাজনৌতিক দলই এখন মাশলম্যানের পূজারী। বলা বাহুল্য এদের দিয়েই বর্তমানে 'রাজ-নীতি' পরিচালিত হয়। অর্থাৎ 'রাজনীতি' বিষয়টাই এখন আর রাজ্যের নীতি নির্ধারণের জায়গায় নেই , পৌঁছে গেছে ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গায়। সেই কারণেই আজ সরকারে এসে কেউ রাজ্যের বা দেশের দায়িত্ব পালন নিয়ে সেভাবে ভাবেন না, যতটা ভাবেন বিরোধীদের নিয়ে। এই বিরোধীদের জব্দ করার সাথে সাথে দেশ বা সমাজের বুকে সাধারণ মানুষের মনে নিজেদের সম্পর্কে একটা ভয় জিইয়ে রাখার জন্যেই প্রয়োজন হয় এইসব মাশলম্যানের , যাদের দিয়ে অশান্তি লাগিয়ে প্রচার করা হয় - 'এটা মানুষের ক্ষোভ'। মজার কথা হল, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওসব ক্ষোভ-টোভ নিয়ে মাথা ঘামানোর মত সময়ই নেই। থাকলে এদেশের চিত্রটাই বদলে যেত। কারণ উগরে দেবার মত বহু ক্ষোভ তাদের ভেতরে রয়েছে , অথচ তারা তা নীরবে হজম করে। এর জন্যেই তো মাশলম্যানরা রয়েছেন।

একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, অন্যান্য খারাপ কাজের ন্যায় মূর্তি ভাঙার মত খারাপ কাজও সেই সব দুষ্কৃতিদের দিয়েই করানো হয়েছে যারা মূর্তির ইতিহাসের ধার ধারেনা। তবে দেশের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা যখন অশিক্ষিতের মত আচরণ করে নিজেরাই দুষ্কৃতিদের দায়িত্ব পালন করে, তখন বুঝতে হবে সমাজে অবক্ষয়ের কালো মেঘ দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে।


মূর্তি ভাঙার ইতিহাস সারা পৃথিবীর বুকেই রয়েছে। জনগনের মন থেকে স্বাধীন চিন্তা ভাবনা তুলে ফেলে নিজেদের মতামত জোর করে প্রবেশ করিয়ে দেওয়াকেই আধুনিক বিশ্বে বলা হয়েছে  'রাজনীতি'। যারা তা করছেন তারা রাজনৈতিক নেতা বা প্রবক্তাও বটে। কিন্তু যে দেশ যুগে যুগে সারা পৃথিবীর মানুষ ও তাদের মতামতকে আপন করে নিয়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নিদর্শন স্থাপন করেছে , সেই নানা ভাষা-নানা মত-নানা পরিধানের দেশ ভারতের কাছ থেকে এটা কি আশা করা যায় ? আজকাল তো মঞ্চে বিবেকানন্দের মত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী কিংবা রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বকবিকে রেখেও রাজনীতি করা হয়। তবে যারা শ্রীরামকৃষ্ণ-পরমহংসকে মানেন, তারা অদ্ভুতভাবেই তার "যত মত তত পথ"-এর আদর্শকে মানেন না। যারা নিজেদের ভারতের ঐতিহ্যের ধারক বাহক বলে প্রচার করেন, তাদের কাছে এটা দ্বিচারিতা নয় ? 

মূর্তি ভাঙার খেলায় সেইরকম রাজনৈতিক প্রবক্তাদের প্রবচনই শোনা গেল - একটা নির্বাচিত শাসকদল আগের নির্বাচিত শাসকদলের গড়ে তোলা জিনিস ভেঙে দিতেই পারে। এখন তবে একটাই প্রশ্ন, কোনো শাসকের পক্ষে একাজ যদি বৈধ হয় ,তাহলে মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার বেলায় সেটা বৈধ বলে তারা মেনে নিচ্ছেন না কেন ?
মনে পড়ে, আমাদের দেশেরই রাজা পুরু বিদেশির কাছে যুদ্ধে হেরেও চেয়েছিলেন-রাজার প্রতি রাজার মত আচরণ। ২৩০০বছর আগে বিদেশি আলেকজান্ডার তা দিতে পারলেও সংস্কৃতি ও প্রগতির বড়াই করা ভারত আজ নিজেরই দেশের মানুষের প্রতি সেই সৌজন্যটুকু দেখাতে পারছে না। .



(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});