ফোকাস বেঙ্গল ওয়েব ডেস্কঃ 'আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে'। হোলির এই আহ্বান যুগে যুগে প্রতিধ্বনিত। পৌরাণিক যুগই হোক বা আধুনিক-হোলির আহবানে সাড়া দেননা এমন মানুষ অন্তত ভারতে নেই। এমনকি দেশের সীমা অতিক্রম করে রঙে রঙে রাঙা হয় বিদেশের আকাশও। এটাই হোলির মাহাত্ম্য। এখানেই বসন্ত উৎসবের সার্থকতা।
বসন্ত বছরের শেষ ঋতু হলেও তার মাধ্যমে নতুনের বার্তা আসে। গাছে গাছে নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি সেই নতুনের বার্তাটিই বহন করে আনে। এসময় ফুলে ফুলে ভরে ওঠে প্রকৃতি। তাই রঙের উৎসব বসন্তে হবেনা তো আর কখন হবে। বসন্ত এসময় যেমন বাইরে, তেমনই ভেতরে। তাই বসন্তোৎসব মানে নিজের রং অন্যকে দেওয়া ,আর অন্যের রঙে নিজেকে রাঙানো। প্রেমের এই আদানপ্রদানের খেলায় রঙের তাৎপর্য আমাদের বেশ ভাল করে বুঝিয়ে দেয় প্রকৃতি। দোল তাই বসন্তেই শ্রেয়।
তবে ভারতের মত আধ্যাত্মিক ভাবধারার দেশে ভক্ত ও ভগবানের লীলাকে স্থান দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক আচার-আচরণে। কারণ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় -"আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।" মাটির মানুষের সঙ্গে ভগবানের সংযুক্তিকরণে ভারতের প্রতিটি উৎসবের রং আরও উজ্জ্বল হয়েছে। হোলির সঙ্গেও তেমনই জড়িয়ে আছে পৌরাণিক গাথা।
একদিকে হোলি খেলা যেমন শ্রীরাধার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলার অন্যতম রূপের প্রকাশ ,অন্যদিকে তেমনি এই উৎসবের আড়ালে রয়েছে 'হোলিকা দহনের' কাহিনী। দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ জন্মালে ঘটে চিরকালের নিয়মের অন্যথা। দেবতাদের চিরশত্রু রাক্ষসের পুত্র হয়ে প্রহ্লাদ বিষ্ণুর ধ্যানে মগ্ন থাকে সর্বদা। পিতা হিরণ্যকশিপু পুত্রকে এই বিষ্ণুভক্তি থেকে বিরত হতে বলেও বারবার ব্যর্থ হন। ফলে তাঁর ক্ষোভ এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে নানা কৌশলে নিজ পুত্রকেই হত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে বারে বারে ত্রাতা হয়ে দেখা দেন স্বয়ং বিষ্ণু। হিরণ্যকশিপুর ভগিনী হোলিকা বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন-আগুনে তাকে পোড়ানো সম্ভব হবেনা। বোনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এবার তার কোলে বসিয়ে প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা নিলেন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু। ভেবেছিলেন বরের জোরে হোলিকা বেঁচে যাবেন। কিন্তু ফল হল উল্টো। আবারও ভক্তের ত্রাতা হয়ে বিষ্ণু প্রহ্লাদকে বাঁচিয়ে পুড়িয়ে মারলেন হোলিকাকে।
'হোলিকা দহন' তাই হোলির একটা অঙ্গ। এখনও হোলিকার একটা প্রতীক তৈরী করে হোলির আগের দিন তাকে নানা দাহ্য বস্তুর মাধ্যমে পুড়িয়ে থাকেন ভারতীয়রা। পরের দিন হোলি পালন করা হয় পাপের বিনাশের আনন্দে। যুক্তিবাদীরা বলবেন এ আসলে বৎসরের আবর্জনা পোড়ানো। কিন্তু যুক্তি যাই হোক, বিনাশ তো সেই খারাপেরই।
আমরা যারা বাঙালি, বসন্ত তাদের কাছে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে মৃদু বাতাসের আনাগোনার মাঝে কুঞ্জে
কুঞ্জে কোকিলের কুহু তানের উন্মাদনায় ভেসে যাওয়া-কোন নব চঞ্চল ছন্দে। বাঙালির এই ভাবনাকে অতিক্রম করতে পিছিয়ে নেই রাঢ় বর্ধমানের মানুষও। তাদের কাছেও বসন্ত ধরা দেয় রঙে আর আবিরের খেলায়। এভাবেই দোল পূর্ণিমার দিনে একে অপরকে রাঙিয়ে দিয়ে যায় তারা।
তবে অন্যান্য স্থানের সঙ্গে শহর বর্ধমানের মানুষের উৎসব পালনের কিছুটা তফাৎ রয়েছে। এখানেও সেই ভক্ত-ভগবানের কাহিনী। তবে একটু অন্যরকম। বর্ধমানের রাজপরিবারের কুলদেবতা ছিলেন রাধানাথ জীউ। দোলপূর্ণিমায় তার পুজো না করে দোল খেলতেন না রাজপরিবারের কেউ। অন্যদিকে রাজা দোল খেলা না শুরু করলে দোল খেলা শুরু হতো না শহরে। কিন্তু একবার কুলদেবতার পুজো শেষ হতে বেলা গড়িয়ে যায়। প্রজারা অধৈর্য্য হয়ে পড়লে রাজা ঘোষণা করেন, শহরে দোল পূর্ণিমার দিনে হবে ঠাকুরের হোলি উৎসব। প্রজারা দোল খেলবেন পরের দিন। সেই থেকেই বর্ধমানবাসী আজও মেনে চলেছেন রাজ আমলের প্রথা।
তবে বর্তমানে দোল পূর্ণিমার দিনে নানা সাংস্কৃতিক উৎসবে সামিল হন শহরবাসী। নাচে-গানে -প্রভাত ফেরীতে দোল উৎসবের সকাল যেমন আবিরের রঙে মাতোয়ারা হয়, তেমনি শহরের গলি থেকে রাজপথও রাঙা হয় উৎসবের রঙে। সন্ধ্যার পূর্ণচন্দ্রে পূর্ণতা পায় বর্ধমানের দোলযাত্রা।