মালা ঘোষ: মাঘের শুক্লা পঞ্চমীতে ফাল্গুনের আভাস। বাঙালির সরস্বতী পুজোর এই ট্রাডিশন সমানে চলছে।সোমবার সরস্বতী পুজোর দিনে তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বিদ্যার দেবীকে আবাহন জানানো হয়েছে বর্ধমানের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। চলেছে অঞ্জলি থেকে প্রসাদ বিতরণ। কাঁসর -ঘন্টা বাজিয়ে পুরুত ঠাকুরের সঙ্গে পুজোর ঘট উত্তোলনে ভিড় করেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কঁচিকাঁচারা। পরনে নতুন পোশাক।যে ফ্রক পরে,এদিন তার গায়েও চড়েছে মায়ের শাড়িটি। বঙ্গতনয়ার শাড়ি পরার শুরুটা মিশে রয়েছে সরস্বতী পুজোর সঙ্গেই। এতো গেলো বালিকার কথা।
কিশোর - কিশোরীদের ক্ষেত্রে সরস্বতী পুজোর দিনেই মনে মনে তৈরী হয় বসন্তের আবহ। ইদানিংকালে বাংলার যুব সমাজ যাকে 'ভ্যালেন্টাইন ডে' বলে থাকে। কারো প্রেমের প্রথম দিন,তো কারো আরও একটু এগিয়ে যাওয়া। সরস্বতী পুজোর চেয়ে উপযুক্ত দিন আর কবেই বা পায় পড়ুয়ারা। 'ফুল ফুটুক, না ফুটুক আজ বসন্ত।'
সোমবার খুব সকাল থেকেই নানা রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল শহরের বিদ্যালয় প্রাঙ্গনগুলি। সে বয়েজ স্কুলই হোক বা গার্লস। নবম - দশম আর একাদশ - দ্বাদশ -এর পড়ুয়াদের ওপর দায়িত্ব থাকে স্কুলে বিদ্যার দেবীর আরাধনাকে সার্থক করে তোলার। সে লক্ষ্যে দুদিন আগে থেকেই মাতে এই সব ছাত্রছাত্রীরা। মণ্ডপ তৈরী,সাজ সজ্জা,আল্পনা,প্রতিমা আনতে যাওয়া,প্রসাদ বিলি সব দায়িত্বই সামলাতে হয় তাদের। স্কুলের দাদা দিদি বলে কথা। শিক্ষক শিক্ষিকাদের বড় ভরসা এই বড় হয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু শুধু কি কাজকমমেই বড় হয়েছে তারা? মনে মনে বড় হয়ে যাওয়া বড় ক্লাসের পড়ুয়াদের মন দেওয়া নেওয়ার বেস্ট দিন এই সরস্বতী পুজো। এদিন তাই পরনের সাজে থাকে অন্যরকম ছোঁওয়া। মায়ের সব চেয়ে দামি শাড়িটা আজ বাড়ীর বড় কিম্বা ছোট মেয়ের জন্য বরাদ্দ। মাথার খোঁপায় একটা গোলাপ,গলায় নেকলেস,হাতে ব্রেসলেট আর লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটে স্কুলের গেটে অপেক্ষা পাজামা - পাঞ্জাবী পরা অমুক স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছেলেটির জন্য। চোখে পড়তেই মুখে হালকা হাসি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাওয়া। ব্যাস। তারপর তার বাইকের পিছনে চেপে হাওয়া। সারাটা দিনের জন্য আর যেন কোনও পিছুটান নেই।
স্কুলের পাশাপাশি কলেজগুলিতেও এদিন সরস্বতী পুজো নিয়ে রীতিমতো উদ্দীপনা ছিল পড়ুয়াদের। তবে তা কতটা ভক্তির আর কতটা ভালোবাসার জন্য তার বিচার করবে কে? দিনটাই তো লাগামহীনতার। শুধু মনে মনে নয়। এদিনে সত্যি করেই হারিয়ে যেতে মানা নেই। কারণ বসন্ত পঞ্চমী কেবলই পড়ুয়াদের দিন। পড়া বাদ রেখে পড়ুয়াদের নিজস্ব দিনের এমন উদাহরণ বোধহয় আর নেই। এদিন মায়ের বকুনি নেই,বাবার শাসন নেই,মাস্টার মশাইয়ের ধমকানি নেই,তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার তারাও নেই - আজ শুধু 'তোমার' সঙ্গে 'আমার' হারিয়ে যাবার দিন।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতী পুজোর চেহারাটা আর পাঁচটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা। এখানে ছাত্র ও ছাত্রীদের হোস্টেলগুলোর মধ্যে পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে চলে কম্পিটিশন। পুজোর দিন সকাল থেকেই ব্যাস্ত ছিল অপেক্ষাকৃত 'ম্যাচিওর' দাদা-দিদিরা। প্রতিযোগিতার ফাঁকেই বয়েজ ও গার্লস হোস্টেলের মধ্যে কখন যেন শুরু হয় আদান প্রদানের বিষয়টি। তা তত্ত্বই হোক বা হৃদয়। ছাত্রীদের তত্ত্বের সঙ্গে অঙ্গ-সজ্জায় ঘায়েল হয় তরুণ হৃদয়। তবে এখানে হারিয়ে যেতে হয় না। সরস্বতী পুজোর প্রেক্ষাপটে এখানে হংসমিথুনের প্রেম বসে ডানা গুটিয়ে।
ছবি - সুরজ প্রসাদ