গ্রামেরই জনা ২০ ছেলেকে নিয়ে তৈরি হল নাটকের দল "এবং আমরা" সালটা ১৯৯৬। প্রত্যেকেই দরিদ্র ও নিম্নবর্গীয় পরিবার থেকে আসা। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই স্থানীয় আদিবাসী পরিবারের। এঁদের মধ্যে কেউ দিনমজুর,আবার কেউ বালি খাদান, পাথর খাদান বা অন্য কোথাও কাজে লিপ্ত।তারই মাঝে নাট্যচর্চার আসর। গ্রাম্য লোককথা, জীবনের কথা, গ্রামের সমস্যা ইত্যাদি উঠে আসত নাটকে। এছাড়া গল্পকথা, উপকথা নিয়েও হত নাটক। তবে প্রত্যেক নাটকেরই একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট থাকত।
একসময় নাট্যকর্মী প্রবীর গুহ ও বাদল সরকারের মতো নাট্যকর্মীরা অনুপ্রাণিত করেছেন এঁদের। নাট্যকর্মী কল্লোল ভট্টাচার্য এবং প্রায় ৩০জন মনস্থির করলেন সর্বক্ষণের জন্য নাটককেই বেছে নেবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে পরিবারগুলি চালানো হয়ে পড়বে অসম্ভব। তখনই ঠিক করেন গ্রামের পতিত জমিতে সব্জি চাষ, ফলের বাগান তৈরি, হাঁস-মুরগি পালনের মতো কাজ করবে এই ‘এবং আমরা’। এখানকার আয়ের একটা অংশ দল চালানোর কাজে লাগান হবে। আর বাকিটা তুলে দেওয়া হবে পরিবারগুলির হাতে। এভাবেই তৈরি করা হবে সর্বক্ষণের নাট্য দল।
গ্রামের প্রান্তে ১২ বিঘা বুনো গাছের জঙ্গলকে বেছে নেওয়া হল এই মহৎ উদ্দ্যেশ্য সাধনে। জমির মালিকের থেকে অনুমতি নিয়ে ১৯৯৯ এ জঙ্গল পরিস্কার করে শুরু করে দেওয়া হল চাষের কাজ। স্বেচ্ছাশ্রম দিতে লাগলেন গ্রামের মানুষ। পুরো জমিটিকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে সময় লাগলো কিছু বছর। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে চালা ঘর তৈরি হয়েছে নাটকের মহড়ার জন্য। ২০০৪ সালে পুরো ক্যাম্পাসটির নিজেরা কিনে নাম দেওয়া হয় "তেপান্তর"। "স্বপ্নের সীমানায় পৌঁছানোর আশায়", নাম নিয়ে করানো হয় সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন। বর্তমানে শুরু হয়েছে হাঁস মুরগি প্রতিপালন, পাশের পুকুরে মাছ চাষ। যত সময় এগিয়েছে, বেড়েছে দলের সদস্য সংখ্যা। বর্তমানে দলের ৩০জনের মধ্যে ১৫জন সর্বক্ষণের কর্মী। সংঙ্গে তৈরি হয়েছে একের পর এক নাটক। আর এরপর শুধুই উত্তরণ।
কল্লোল ভট্টাচার্য ও তাঁর দলের সঙ্গে আজ দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন দল তেপান্তরে এসে টানা ২০ - ৩০ দিনের কর্মশালা করে ‘এবং আমরা’ এর সঙ্গে। তাঁদের থাকার জন্য ছোট ছোট চালাঘর তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে শৌচাগার। কর্মশালার শেষ দিনে নাটক দেখতে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন নাটক দেখতে। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় তেপান্তরকে ফার্মহাউস হিসেবে না দেখে নাট্যগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
কল্লোল ভট্টাচার্য ও তাঁর দলের সঙ্গে আজ দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন দল তেপান্তরে এসে টানা ২০ - ৩০ দিনের কর্মশালা করে ‘এবং আমরা’ এর সঙ্গে। তাঁদের থাকার জন্য ছোট ছোট চালাঘর তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে শৌচাগার। কর্মশালার শেষ দিনে নাটক দেখতে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন নাটক দেখতে। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় তেপান্তরকে ফার্মহাউস হিসেবে না দেখে নাট্যগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
সেই মত তেপান্তরের ভিতরই কর্মশালা, নাট্যোত্সব ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে দলের অনেকেই সপরিবারে তেপান্তরের মধ্যেই বসবাস শুরু করেন। নতুন নতুন স্পেস নিয়ে কাজ শুরু হয়। কল্লোল ভট্টাচার্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচিত হন, পরিচিত হন তাঁদের কাজের সঙ্গে, সমৃদ্ধ হয় তাঁর নাটক। তেপান্তরের প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ নাটকের উপাদান। তৈরি করছেন নাটকের ঘরনা- স্পেস থিয়েটার। মহাকাব্যের পরে, খুনির মা, ইদিপাস ইত্যাদি নাটকগুলি 'এবং আমরা'কে দিয়েছে সর্বভারতীয় পরিচিতি।
গ্রামবাংলার লোকশিল্পী, হস্তশিল্পী, রায়বেঁশে, বাউলদের নিয়ে এই তেপান্তরে চলছে কর্মশালা এবং এই কর্মশালা থেকে বেরনো শিল্পীরা দেশ বিদেশে নাম করার সাথে সাথে তৈরী করছেন শিল্পের নতুন ফিউশন। প্রতিমুহূর্তে বদলে যাওয়া শিল্প চাহিদার পরিপূরক হয়ে উঠেছে তেপান্তর। বর্তমানে চলছে বীরভূম, বাঁকুড়া ও বর্ধমানের অধিবাসী মহিলাদের জীবনযাত্রা এবং মান উন্নয়নের প্রশিক্ষণ। সংঙ্গে পেয়েছেন ইউনেস্কোর ন্যাশনাল পার্টনার 'বাংলা নাটক ডট' । এদের অক্লান্ত পরিশ্রম তেপান্তরকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। সহায়তা দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ।
২৪ থেকে ২৬ শে নভেম্বর ২০১৭ চলেছে তেপান্তর মেলা। তিনদিন ব্যাপী তেপান্তর মেলায় প্রতিদিন ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লোকসংগীত, ছৌ, রায়বেঁশে নাচ ও 'এবং আমরা' র নাটক। তেপান্তর এখন গ্রামীণ লোক সাংস্কৃতিক পর্যটনকে ভিত্তি করে ইকো-ট্যুরিজম-এর আদর্শ জায়গা। তেপান্তর এখন শুধুই নাট্যগ্রাম নয়, এলাকার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উত্তরণের ভরকেন্দ্র।
আজ তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে গান্ধীজীর স্বয়ম্বর গ্রাম চিন্তাকে সঠিক অর্থে বাস্তবায়িত করার পথে তেপান্তর।