মালা ঘোষ: সেল-সেল-সেল ! চৈত্রের চেনা শব্দ। "নিয়ে যান দাদা ,মাত্র ১০০ টাকায় , এই যে দিদি, চলে আসুন ,নামমাত্র দামে শাড়ি নিয়ে যান"- হকারের হাঁক-ডাকের মধ্যে দিয়েই কখন যেন বছর শেষের ঢাকে কাঠি পড়ে যায়, আর সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় ব্যবসায়ীর স্টক -ক্লিয়ারেন্স অফার-'চৈত্র সেল'। বাঙালির ইয়ার এন্ডিং বাজারের এই মুহূর্তগুলো উদ্দীপনায় ভরা। পরিবারের রোজগেরে পুরুষটির সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আপস নয়। চৈত্রের শেষের দিনগুলোতে কখন যেন ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে হোম মিনিস্টার গিন্নি। বাড়ির কর্তা বদলে যায় 'জরু কে গোলাম' এ।
প্রত্যেক বছর চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই রাস্তার দুধারে বিস্তর জিনিসপত্র নিয়ে বসে পড়ে ছোট দোকানিরা, যাদের সাধারণ ভাষায় মূলত হকার বলা হয়ে থাকে। জামা -কাপড়,বিছানার চাদর, মশারি, লুঙ্গি,গেঞ্জি,এমনকি জুতো থেকে পাপোশ পর্যন্ত চৈত্র সেলের আওতায় চলে আসে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি হয় সেসব।
আবার বড়সড় ব্যবসাদাররা আজকাল বাসনপত্র কিংবা ফার্নিচারের ওপরেও ডিসকাউন্ট দেন এসময়। অভাবনীয় ছাড় দেয় ব্র্যান্ডেড পোশাক কোম্পানি গুলো-২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। অভিজাত বস্ত্র প্রতিষ্ঠানে ৫০% অবধি ছাড়ের সুযোগ নিতে দোড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায় মধ্যবিত্ত বাঙালির। পিছিয়ে থাকেনা গয়নার বাজারও। তাদেরও থাকে চৈত্র সেল থেকে নববর্ষের নানা অফার।
আসলে চৈত্রের শেষের এই বাজারেই স্বপ্নপূরণ হয় নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের। বাঙালির সেরা উৎসব দূর্গা পুজোর সময় নতুন জামা পড়ার সাধ কার না হয়। কিন্তু সে সময় 'শপিং' করা সাধ্যে কুলায় কত জনের। তাদের ভরসা এই চৈত্র সেল। একথা ব্যবসায়ীরাও বোঝেন। তাই তারাও সেলের বাজার সাজিয়ে তোলেন। তাছাড়া নতুন জামা পরে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রথা বাঙালির বহুদিনের। অর্থাৎ 'চৈত্র সেল' মানেই হল সস্তায় পুষ্টিকর কিছু পাওয়া, আর তার মধ্যে দিয়ে কি যেন একটা জেতার আনন্দ। সেই জিতে নেবার লড়াই চলে মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
টানা একমাস ছুটোছুটির মাঝে পড়ে ততদিনে তথৈবচ অবস্থা বাড়ির পুরুষটির। কিন্তু ওই যে-ফেলু গোয়েন্দার মত বউ-এর অর্ডার-'কোনো প্রশ্ন নয়'। ভিড়ের গুঁতো ,সাইকেলের ধাক্কা ,হকারের কান ফাটানো চিৎকার, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরমে সেদ্ধ হওয়া। তবে সব যন্ত্রনা এক নিমেষে দূরে চলে যায় যখন বাড়িতে গিয়ে সস্তায় জিতে আসার হিসেবটা মিলিয়ে নিয়ে এক গাল হেসে বউ বলে -"এই পাঞ্জাবিটা তোমার ,পয়লা বৈশাখের দিন পড়বে"।
এভাবেই গলি থেকে রাজপথের পরিক্রমা সেরে চৈত্র সেলের কেনাকাটার দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকেন গৃহকর্তা, আর ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে ভয়ঙ্করের মধ্যেও সুন্দরের খোঁজ করেন সুগৃহিণী।